স্বদেশ ডেস্ক:
সুদহার কমিয়ে ও নানা কড়াকড়ির পর নিরাপদ বিনিয়োগের ক্ষেত্র সঞ্চয়পত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে মানুষ। ফলে প্রতিমাসে কমে যাচ্ছে নিট বিক্রির পরিমাণ। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের নভেম্বরে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে মাত্র ৭০১ কোটি টাকা। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৫ গুণ কম। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে প্রায় সাড়ে ৪৭ শতাংশ। অর্থাৎ গতবারের চেয়ে এবার নিট বিক্রি অর্ধেকে নেমে এসেছে। অথচ গত অর্থবছরে করোনার সংক্রমণের প্রভাবে মানুষের আয়ে বড় ধরনের প্রভাব পড়ার পরও সঞ্চয়পত্রে নিট বিক্রি ব্যাপকহারে বেড়েছিল।
নিম্ন-মধ্যবিত্ত, সীমিত আয়ের মানুষ, মহিলা, প্রতিবন্ধী ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য সঞ্চয়পত্রের বিভিন্ন প্রকল্প চালু রয়েছে। সামাজিক সুরক্ষার কথা বিবেচনায় নিয়ে সঞ্চয়পত্রে তুলনামূলক বেশি মুনাফা (সুদ) দেয় সরকার। ব্যাংকের আমানতের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদহার বেশি হওয়ায় কয়েক বছর শুধু নিম্ন মধ্যবিত্তরাই নয়, সমাজের উচ্চবিত্ত ও বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানও এর সুবিধা নেন। এতে অস্বাভাবিকভাবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক সময়ে সঞ্চয়পত্র কেনায় নানা কড়াকড়ি আরোপ এবং মুনাফার হার কমানো হয়েছে। এর পর থেকে নিট বিক্রি কমে যাচ্ছে। ফলে এ খাত থেকে সরকারের চাহিদা অনুযায়ী ঋণ না পাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এতে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার ঝুঁকছে ব্যাংকঋণে।
বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের মূল বা আসল পরিশোধের পর যা থাকে, তা নিট বিক্রি হিসেবে পরিগণিত হয়। এই নিট বিক্রিকে সরকারের ঋণ বলা হয়। প্রতি অর্থবছরের বাজেটে নিট বিক্রি হিসেবে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকা। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের প্রাপ্ত তথ্য বলছে, সর্বশেষ নভেম্বরে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে মাত্র ৭০১ কোটি টাকা। এটি গত বছরের নভেম্বর মাসের চেয়ে প্রায় ৫ গুণ কম। ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে ৩ হাজার ৪০২ কোটি ৫৭ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) সঞ্চয়পত্র নিট বিক্রি হয়েছে ১০ হাজার ২৫ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৪৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ কম। গত অর্থবছরে প্রথম পাঁচ মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি হয়েছিল ১৯ হাজার ৪৪ কোটি ৯২ লাখ টাকার। অর্থাৎ গত অর্থবছরের ৫ মাসেই পুরো বছরের লক্ষ্যমাত্রার ৯৫ শতাংশ নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। এবার প্রথম পাঁচ মাসে হয়েছে মাত্র ৩১ শতাংশ।
গতবছরের ২১ সেপ্টেম্বর সঞ্চয়পত্রে ১৫ লাখ টাকার ওপরে বিনিয়োগের মুনাফার হার দুই শতাংশ পর্যন্ত কমানো হয়েছে। তবে ১৫ লাখ টাকার নিচে মুনাফার হার অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এ ছাড়া চলতি বাজেটে ২ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে হলে কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ ছাড়া পাঁচ বছরমেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র শুধু সঞ্চয় অধিদপ্তরের মাধ্যমে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর আগে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ সীমা কমিয়ে আনা হয়। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র এবং পরিবার সঞ্চয়পত্র- এই তিনটি স্কিমের বিপরীতে সমন্বিত বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা একক নামে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ এবং যৌথ নামে সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। আগে একক নামে সর্বোচ্চ এক কোটি ৫৫ লাখ এবং যৌথ নামে দুই কোটি ১৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে পারতেন গ্রাহকরা। এসব পদক্ষেপের কারণে সঞ্চয়পত্র থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্ল্ষ্টিরা।
করোনার পরও গত অর্থবছরে তার আগের অর্থবছরের চেয়ে তিন গুণ বেশি সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে সরকার সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি হয়েছিল প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা। এটি আগের অর্থবছরে ছিল মাত্র ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা।
এদিকে, সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়ায় ব্যাংকঋণ নির্ভরতা বেড়েছে সরকারের। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নিট ঋণ নিয়েছে প্রায় ১৮ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা।